মহামারির দিনে পরিবেশ দিবস

এমন এক সময়ে এবার পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে যখন করোনাভাইরাস মানব সভ্যতাকে এক কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সিংহভাগ জুড়ে বিরাজ করছে স্থবিরতা এবং অস্থিরতা, একুশ শতকের জীবনযাত্রা ও মানুষের নিরাপত্তা এক অভাবনীয় ঝুঁকির মুখে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা কি নিজে থেকেই তৈরি হয়েছে? নাকি মানুষ নিজের হাতে এই থমথমে পরিস্থিতি তৈরি করেছে? পরিসংখ্যান কী বলে?

গত ৫০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে বর্তমানে সাড়ে ৭০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।এই বিপুল সংখ্যক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি থেকে প্রতি বছর যে সম্পদ প্রয়োজন তা সরবরাহ করতে ১.৬টি পৃথিবীর দরকার!

যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা এবং উৎপাদন ও ভোগের হার অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৫০ সালে ৯৬০ কোটি মানুষের জন্য দরকার হবে ৩টি পৃথিবী। এই সময়ের মধ্যে যদি পৃথিবীর মতো আরও গ্রহ আবিষ্কার হয় এবং সেখানে আমরা গিয়ে বাস করা শুরু করি তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে আগামী দিনগুলোর বিপর্যয় এড়াতে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া জরুরি।

পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতার বেশি মানুষের চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রকৃতি। যে জীববৈচিত্র্য মানুষকে রক্ষা করে সেই প্রকৃতিরই ক্ষতিসাধনের এক প্রতিযোগিতায়, আমরা সবাই ব্যস্ত; কেউ জেনে, কেউ না জেনেই। বন উজার, বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল ধ্বংস, অতিমাত্রায় কৃষি সম্প্রসারণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রকৃতি আজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে।

ফলে, কোভিড-১৯ এর মতো এমন ভয়ংকর মহামারির পথ উন্মুক্ত হয়েছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) তথ্য বলছে, প্রতি চার মাসে গড়ে একটি সংক্রামক রোগ মানুষে সংক্রমিত হয়। এসব সংক্রামক রোগের ৭৫ শতাংশই আসে প্রাণী থেকে।

২০০২ সালে সার্স (SARS) ও এভিয়ান ফ্লু (AVIAN FLU), ২০১২ তে মার্স (MERS), ২০১৪-২০১৫ ইবোলা (Ebola) এরপর ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস (West Nile virus), জিকা ভাইরাস (Zika virus) এবং এখন করোনাভাইরাস- এর সবই মানুষের কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত। বন উজারের ফলে বন্যপ্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসায় পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বলছেন বিজ্ঞানীরা।

১৯৯৭ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা পুনঃপ্রাদুর্ভাবের কারণ অতিরিক্ত পোল্ট্রি ফার্ম (প্রথম সংক্রমণ হংকং-এ)। মালয়েশিয়ায় নিপাহ ভাইরাসের উত্থানের পেছনে অতিরিক্ত শূকর খামার ও ফল উৎপাদনকে কারণ হিসেবে দেখা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, করোনাভাইরাস এসেছে বাদুর থেকে।

বাদুর হচ্ছে মানুষের জন্য খুবই উপকারী। বাদুর একমাত্র উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী যাকে রাত্রিকালীন পরাগায়ণকারী বলা হয়। পাকা ফল খেয়ে তাদের যাত্রাপথে কোটি কোটি বীজ ছড়িয়ে দেয়। ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট পুনঃবনায়নের (Reforestation) প্রায় ৯৫ শতাংশ হয় বাদুরের ছড়ানো বীজ থেকে। বাদুরের মলে (Droppings) প্রচুর ফসফরাস ও নাইট্রোজেন থাকে, যা জমিতে সার হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক পোকা দমনকারী হিসেবেও কাজ করে বাদুর। অথচ মানুষ তাদের বাসস্থান ধ্বংস করেছে।

তাহলে দোষটা কার? বাদুরের না মানুষের?

G M Mostafizul Alam

 

 

পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের ৩০ শতাংশ বনভূমি যেখানে ৮০ শতাংশ প্রাণী, উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বাস এবং পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষের জীবিকার উৎস। বনের গাছপালা কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখে। কিন্তু শিল্পায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ ও অতিরিক্ত বনজ সম্পদ আহরণের কারণে প্রতি বছর ৭০ লাখ হেক্টর বন ধ্বংস হয়, যা আয়তনে পর্তুগালের মতো একটি দেশের সমান।

৮০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে পৃথিবীতে। কিন্তু মানব ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে ১ হাজার গুণ বেশি গতিতে এসব প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি (প্রাণী ও উদ্ভিদ)। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন আমরা ‘সিক্সথ ম্যাস এক্সটিংশন’ এ প্রবেশ করছি। সায়েন্টিফিক আমেরিকার হিসাব, বিশ্বে প্রতিদিন বিলুপ্ত হয় ১৩৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও পোকামাকড়।

বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের কারণে মানুষের সংস্পর্শে আসছে বন্যপ্রাণী। অথচ, একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম রোগবালাই থেকে আমাদেরর রক্ষা করতে পারে। সমৃদ্ধ বন বা জীববৈচিত্র্য থাকলে রোগজীবাণু দ্রুত ছড়াতে পারে না। তাই, আগামী কোনো মহামারি থেকে বাঁচতে বন্যপ্রাণী নিধন, পাচার ও তাদের বাসস্থান ধ্বংস এখনই বন্ধ করতে হবে।

মানুষের খাবারের জন্য পৃথিবীতে যত উদ্ভিদ জন্মায় তার ৭৫ ভাগ অর্থাৎ, ১১৫টি প্রধান খাদ্যশস্যের ৮৭টির পরাগায়ন নির্ভর করে প্রাণীর ওপর। সেই প্রাণী আর তাদের আবাসস্থলই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে মানুষের খাদ্য আসবে কোত্থেকে?

একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন থামাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। কেননা, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহ গলতে শুরু করেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে বরফের নিচের মাটির পারমাফ্রস্ট স্তর বেরিয়ে আসছে এবং সেখান থেকে প্রাচীন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া উন্মুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে বরফগলা পানিতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে অনেক কৃষিভূমি বা বসতি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।  সেই সাথে বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগও। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনও মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফসল।

পর পর পাঁচ বার বিশ্বের শীর্ষ এনজিও-র স্থান অর্জনকারী  ব্র্যাক এই সমস্যা উপলব্ধি করেছে অনেক আগেই। তাই, সমাজ উন্নয়নে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্র্যাক তার সমস্ত কার্যক্রমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। এর জন্য আছে সুনির্দিষ্ট পরিবেশ নীতিও।

ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ২০১৬-২০২০ এর আলোকে ‘জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি’ (সিসিপি) টেকসই উন্নয়ন অনুশীলনের মাধ্যমে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়নো এবং ঝুঁকি প্রশমনে কাজ করছে।

মানুষ তার ব্যক্তি জীবন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে একটু সচেতন হলেই পরিবেশ রক্ষার কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। দরকার সরকরি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রয়াস। তাই পরিবেশ রক্ষা, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগই হোক এবারের পরিবেশ দিবসের ব্রত। পরিবেশকে ভালো রাখি, মানুষের জীবনকে সুন্দর রাখি ।

This blog published on Brac Blog: 03 June 2020